বারো বছর বেতন বাড়েনি এক টাকাও, এজেন্সি দিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে বৃত্তিমূলক শিক্ষকদের
কোন বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে হলে শুরু থেকে শুরু করাই ভালো। তাই গোড়ার কথা দিয়েই শুরু করছি। -
দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও বেকার সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার যৌথভাবে স্কুল এডুকেশনে ভোকেশনালাইজেশন এর পথ বেছে নেন। এতে সুবিধা হল এই যে, সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি লেভেলে পাঠ্যরত ছাত্র-ছাত্রীরা অন্যান্য সাধারণ বিষয়গুলির সাথে সাথে একটি বৃত্তিমূলক বিষয়ে শিক্ষা পাবে। যাতে তাদের নলেজ ও স্কিল বৃদ্ধি পাবে। এরপর ভার্টিক্যাল মোবিলিটির রাস্তায় হেঁটে তারা উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারবে বা হরাইজেন্টাল মোবিলিটির রাস্তায় গিয়ে স্কুল লেভেলে প্রাপ্ত শিক্ষা ও স্কিল সার্টিফিকেট এর সাহায্যে নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে।
২০১৩ সালে হরিয়ানা এবং পশ্চিমবঙ্গে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে এই প্রকল্পটি চালু হয়। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে এই স্কীমটি চালু করার পিছনে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী অবদান অগাধ। সাফল্যের সাথে তিন বছর চলার পর ২০১৬ সাল থেকে NSQF ( ন্যাশনাল স্কিল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক) -এর CSS-VSE ( সেন্ট্রালি স্পনসর্ড স্কীম ফর ভোকেশনালাইজেশন অফ স্কুল এডুকেশন) পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে সফলভাবে চলতে থাকে। NSQF এর অধীন হওয়ায় পাঠ্যসূচিটি জাতীয় স্তরের, অর্থাৎ সারাদেশেই এই একই কারিকুলাম ফলো করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন VTC(Vocational Training Centre) এর মাধ্যমে অন্য একটি ভোকেশনাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা আছে, যা সম্পূর্ণভাবে রাজ্যের ভোকেশনাল কাউন্সিল দ্বারা পরিচালিত এবং এর সাথে আমাদের CSS-VSE এর কোন সম্পর্ক নেই।
আমরা স্কুল শিক্ষার নবম-দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত স্থায়ী বৃত্তিমূলক বিষয়ের ( অটোমটিভ, এগ্রিকালচার,অ্যাপারেল,ব্যাঙ্কিং, বিউটি এন্ড ওয়েলনেস, কনস্ট্রাকসন, আইটি, ইলেকট্রনিক্স, পাওয়ার, রিটেল, ট্যুরিসম এন্ড হসপিটালিটি ,স্বাস্থ্য পরিষেবা , প্লামবিং , টেলিকম, ইত্যাদি) CSS-VSE (NSQF) শিক্ষক-শিক্ষিকা । CSS-VSE (NSQF) শিক্ষকরা হচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত বৃত্তিমূলক বিষয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা যারা স্কুল শিক্ষার অন্যান্য স্থায়ী শিক্ষকের মতোই NCERT ও রাজ্য সরকারের সমস্ত গাইডলাইন মেনে নিয়োগ হয়েছেন। বর্তমানে 1611টি সরকার ও সরকার পোষিত উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় 3222 জন CSS-VSE (NSQF) শিক্ষক-শিক্ষিকা কর্মরত।
অথচ, আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমের স্থায়ী বৃত্তিমূলক বিষয়ের পূর্ণ সময়ের শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও, গত 12 বছর ধরে অস্থায়ীভাবে আছি এবং 1টাকাও বেতন বৃদ্ধি হয়নি ( উল্টে হাতে পাওয়া বেতন 25% কমে গেছে) যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরলতম ঘটনা। যেখানে , স্থায়ী শিক্ষকদের বেতন গত 10-12 বছরে 250% বৃদ্ধি পেয়েছে , সেখানে আমরা বঞ্চিত,শোষিত, লাঞ্ছিত ও সামাজিকভাবে অপমানিত হয়ে চলেছি দিনের পর দিন।
অন্যান্য অনেক রাজ্যের CSS-VSE (NSQF) শিক্ষকরা ইতিমধ্যেই স্থায়ী শিক্ষকের মর্যাদা পেয়েছেন এবং তাদের বেতন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি , এই রাজ্যেও স্কুল শিক্ষার অন্যান্য সকল অস্থায়ী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের(ICT, SSK, MSK etc.) বেতন প্রায় 100% এরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।তাছারাও, CSS-VSE NSQF ডিস্ট্রিক্ট কোর্ডিনেটরদেরও বেতন 40% বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র 4.5 বছর কাজ করে।
সারা ভারতবর্ষে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের বৃত্তিমূলক পাঠক্রম স্কুল শিক্ষা দপ্তরের মাধ্যমে সরাসরি পরিচালিত হলেও কেবলমাত্র আমাদের রাজ্যে CSS-VSE (NSQF) বিষয়গুলি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও কোনও অজ্ঞাত কারনে কারিগরী দপ্তরের (DVET) মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে । কারিগরী দপ্তর(DVET) আবার এজেন্সীদের মাধ্যমে CSS-VSE (NSQF) পরিচালিত করছে । তারফলে ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দুর্দশা চরম সীমায় পৌঁছেছে।
বিগত বেশ কিছু বছর ধরে ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠ্য বইটুকু পর্যন্ত পাচ্ছে না, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট এবং গেস্ট লেকচারের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুলে যে নূন্যতম অফিস কন্টিনেন্সি ও ট্রেনিং মেটেরিয়াল বরাদ্দ ছিল তাও আসে না।
Highly qualified CSS-VSE (NSQF) শিক্ষকরা যে বেতন পান তা সংসার চালানোর পক্ষে উপযুক্ত নয়। আবার, এজেন্সীরা অনিয়মিতভাবে বেতন প্রদান করে ও EPF , ESI এর টাকাও নিয়ম মাফিক জমা করেন না। এজেন্সীরা শিক্ষক-শিক্ষকাদের হুমকি দেন তাদের প্রাপ্য বেতন ও ছাত্র-ছাত্রীদের সরকারের বরাদ্দকৃত পরিষেবা চাইলে।যেখানে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নারীশক্তির প্রতীক সেখানে বাংলার CSS-VSE (NSQF) এর নারীশক্তিরা মা হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ( ম্যাটারনিটি লিভ পান না)। এজেন্সীরা ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন ভাবে প্রলোভিত করে প্রতারিত করছে। এজেন্সীদের দিয়ে CSS-VSE (NSQF) পরিচালিত হওয়ার ফলে রাজ্যে সরকারের অতিরিক্ত 80 কোটির বেশি খরচ হচ্ছে আর স্কিল শিক্ষা পিছিয়ে যাচ্ছে। লাভবান হচ্ছে কেবলমাত্র শোষনকারী এজেন্সীরা। কার স্বার্থে এই এজেন্সী প্রথা, তার কোন সদুত্তর নেই। এজেন্সীদের কোনও ভূমিকা নেই কমিশন নেওয়া ছাড়া । হরিয়ানা , আসাম , কেরালা , মিজোরাম , গোয়া ইত্যাদি রাজ্য ইতিমধ্যেই শোষনকারী এজেন্সী প্রথার অবসান ঘটিয়েছে।
আমরা জানি "বাংলা আজ যা ভাবে, সারাদেশ আগামীকাল তা ভাবে", তাহলে এই ক্ষেত্রে কেন ব্যতিক্রম! কেন বাংলা অন্যান্য রাজ্যের থেকে এত পিছিয়ে থাকবে?
Highly qualified ( B.E./B.Tech , MCA, M.tech, MBA, B.pharm , M.pharm , BHMS, B.Sc ( Nursing) , MTM, BHM etc) CSS-VSE (NSQF) VOCATIONAL শিক্ষকরা এতটাই পারদর্শী ও দক্ষ যে 120: 1 ছাত্র- শিক্ষক অনুপাত হওয়া সত্ত্বেও ছাত্র-ছাত্রীরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বৃত্তিমূলক বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে গড়ে 90% এর বেশি নম্বর পাচ্ছে। এর পাশাপাশি, এই সব দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে হাতে কলমে শিক্ষা লাভ করে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছে। 2021 সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে মাধ্যমিক স্তরে 1জন ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে 1জন CSS-VSE (NSQF) শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োজিত ছিল। এমনকি CSS-VSE (NSQF) ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ও নিয়োজিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে স্কুলে 1টি বৃত্তিমূলক বিষয়ের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে মাত্র 1 জন স্কিল শিক্ষক পাঠদান করেন এবং সপ্তাহে বৃত্তিমূলক বিষয়ের জন্য 26-28 টি পিরিয়ড নিতে হয় এবং ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজও করতে হয়। তাছাড়াও, আপার - প্রাইমারি স্তরে বিভিন্ন বিষয়ের ক্লাস নিতে হয় ও কারিগরী বিষয়ে দক্ষতা থাকায়, বিদ্যালয়ের অফিসিয়াল কাজও করতে হয় । এমনকি , মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের বৃত্তিমূলক বিষয়ের পরীক্ষক হিসাবে আমাদের নিয়োগ করা হয় এবং নির্বাচনে আমাদের পোলিং অফিসার হিসাবেও নিয়োগ করা হয়। তাই, 2021-22 সালে আমাদের 3 গুন কাজের চাপের কথা চিন্তা করে, নতুন শিক্ষানীতিতে স্কিল বেসড বৃত্তিমূলক বিষয়ের অপরিহার্যতার( কারন নতুন শিক্ষানীতিতে বৃত্তিমূলক বিষয়কে অন্যান্য সাধারণ বিষয়ের মত করে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে চালনা করা হচ্ছে) কথা মাথায় রেখে, আমাদেরকে তৎকালীন দপ্তরের আধিকারিকরা আশ্বস্ত করেছিলেন স্কুল শিক্ষার বৃত্তিমূলক বিষয়ের CSS-VSE (NSQF) শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও সম্মানজনক বেতন কাঠামোসহ স্থায়ীকরন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে 10-12 বছর কেটে গেলেও স্কুল শিক্ষায় একমাত্র আমরাই বঞ্চিত থেকে গেছি। এই মুহূর্তে শোষনকারী এজেন্সীদের সরিয়ে আমাদের বেতন বৃদ্ধি ও বেতন কাঠামোসহ স্থায়ীকরন না করলে আমাদের পরিবার পরিজন নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না।
আমরা বছরে পর বছর আমাদের আবেদন কারিগরী দপ্তর, স্কুল শিক্ষা দপ্তর , নবান্ন, বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রী দের জানিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। এমনকি আমরা সরাসরি আমাদের স্থায়ীকরনের ও বঞ্চনা অবসানের দাবি মুখ্যমন্ত্রীর নবান্ন ও কালীঘাটের অফিসে জমা করেছি এবং cmro তেও আমাদের করুন বার্তা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছনোর চেষ্টা করেছি। কিন্ত এখনও পর্যন্ত আমাদের ন্যুনতম দাবিও পূরণ হয়নি। যদিও আমাদের বারংবার অনুরোধ ও cmro তে বহু সংখ্যক গণমেলের কারনে , মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের অফিসের সংশ্লিষ্ট OSD গত 23.03.25 তারিখে আমাদের কথা দিয়েছিলেন আমাদের ( CSS-VSE NSQF) ফাইল খুব তাড়াতাড়ি মুখ্যমন্ত্রীর নিকট প্লেস করা হবে, শুধু এটুকুই আমাদের আশার আলো।
আমরা সরকারের সাথে ছিলাম , আছি ও থাকব। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ,, আমাদেরকে একটি সুযোগ দিন আমাদের সমস্ত দুঃখ, দুর্দশা এবং অন্যান্য অসুবিধা গুলো অপসারণের জন্য আপনার সাথে প্রয়োজনীয় সদর্থক আলোচনার। আপনারাই আমাদের একমাত্র আশার আলো যাঁরা এই হাজার হাজার পরিবারের নিভে যাওয়া মোমবাতি আবার প্রজ্জ্বলিত করতে পারেন।
মুখ্যমন্ত্রী তথা সরকারের নিকট আমাদের মূল বার্তা :
"জীবন আমাদের বিপন্ন ,
তাইতো আমরা আপনার শরণাপন্ন"।
পরিশেষে বলি-
কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
3222 জন CSS-VSE NSQF শিক্ষক-শিক্ষিকা ও তাদের পরিবার এবং প্রায় 3 লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের ভবিষ্যৎ?
না
CSS-VSE (NSQF) এর শোষনকারী ২৯ টি এজেন্সী?
এমনকি, এজেন্সী সরিয়ে আমাদের বেতন বৃদ্ধি ও বেতন কাঠামোসহ স্থায়ীকরন করলে রাজ্য সরকারের অতিরিক্ত কোনও খরচ হবে না।
Comments
Post a Comment